Description
পাঁচটি মসলা জাতীয় খাদ্যের বীজ রান্নার পরে ‘ফোঁড়ন’ হিসাবে ব্যবহারকে পাঁচফোঁড়ন বলে। ‘ফোঁড়ন’ মানে হাল্কা তেলে কিম্বা ঘিয়ে বীজগুলো টেলে রান্না বা সেদ্ধ করা শাক বা শব্জির ওপর দেওয়া। ব্যস। উদ্দেশ্য হচ্ছে শাকশব্জির ঘ্রাণ ও স্বাদ উসকে দেওয়া। গরম তেল বা ঘিয়ে বীজগুলো লাফায়। আমাদের রান্না পদ্ধতির মধ্যে এই প্রকার ‘উসকানি’র গুরুত্ব অপরিসীম। এখান থেকে আমরা ‘ফোঁড়ন’ কাটা কিম্বা কারো কথায় উসকানি দেওয়া অর্থে শব্দটি ব্যবহার করি।
তেলে কিম্বা ঘিয়ে টেলে বীজের দানার ‘ফোঁড়ন’ দেওয়া কথাটা সম্ভবত ভোজপুরি বা মৈথিলী ভাষা থেকে আসা। পাঁচফোঁড়ন বাংলাদেশ ও তার আশপাশের ভূখণ্ডের মানুষদের খাদ্য ও রান্না ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ দিক। বিশেষত বাংলাদেশ, আসাম ও উড়িষ্যার। আরেকটি শব্দের সঙ্গে আমরা পরিচিত, বাঘার বা বাঘাড় দেওয়া। এটা আদিতে উড়িয়া শব্দ। আমরা যাকে ‘ফোঁড়ন’ বলি উড়িয়াতে সেটাই বাঘার দেওয়া। তবে বাংলাদেশে তেলে বা ঘিয়ে ভেজে গরম গরম ডালে বা শব্জিতে পেঁয়াজ, রসুন সহ যে ‘বাঘার’ দেওয়া হয় সেটা ফোঁড়ন দেওয়া থেকে আলাদা। এখন ‘ফোঁড়ন’ দেওয়া আর ‘বাঘার’ দেওয়ার উদ্দেশ্য অভিন্ন হলেও দুটো দুই পদ্ধতি। তাদের উপাদানেও ভিন্নতা আছে। পাঁচফোড়ন কখনও বেটে ব্যবহার করা হয়না। সব সময় আস্ত ব্যবহার করা হয়। সবজি ভাজি, ডাল, ও আচারে পাঁচফোড়ন ব্যবহার করা হয়। তবে বিভিন্ন প্রকার ঝাল আচার তৈরী করার সময় আধ বাটা করে গুঁড়া মশলা ব্যবহার করা হয়।
পাঁচফোঁড়ন তাহলে পাঁচটি মশলা জাতীয় উদ্ভিদের বীজ। পাঁচফোঁড়নকে সে কারনে মশলা বলা যাবে না। আমাদের রান্না ব্যবস্থায় ‘মশলা’ মানে হচ্ছে রান্নার জন্য যা বেটে বা গুঁড়া করে রান্নার সঙ্গে মিশিয়ে পাক করা হয়। পাঁচফোঁড়নের ভূমিকা রান্নার আগে নয়, পরে। রান্না – বিশেষত রান্নার শেষে শব্জির ঘ্রাণকে জাগিয়ে তুলে তার স্বাদ আরও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করা যেমন পাঁচফোঁড়নের উদ্দেশ্য, তেমনি খাবারের ঠিক আগে একটুখানিক তেলে পাঁচটি উদ্ভিদের বীজ টেলে সুগন্ধে রান্নাঘর ও খাবারের টেবিল আমোদিত করাও পাঁচফোঁড়নের উদ্দেশ্য। পাঁচফোড়নের আবেদন যতোটুকু না জিহ্বায় তার চেয়ে অনেক বেশি ঘ্রাণে। খাবারের সঙ্গে ঘ্রাণের সম্পর্ক অতিশয় বঙ্গীয় বলেই মনে হয়, রান্না করা খাদ্য দেখতে কেমন সেই দিকটা আমাদের রান্নার ব্যাকরণে গৌণ। ইউরোপীয় খানাপিনার সঙ্গে তুলনা করলেই আমরা সেটা বুঝি। ঘ্রানেন্দ্রিয় বা নাকের সঙ্গে পাঁচফোঁড়নের সম্পর্ক আছে, আপাতত এটা মনে রাখলে আমাদের রান্নার বিশেষ বৈশিষ্ট্য খানিকতা আমরা ধরতে পারব। তুলনায় শরীরের পুষ্টি ও শক্তি জোগাবার জন্য খাদ্যের ভুমিকা আলাদা। সেটা পাঁচফোঁড়নের কাজ না।
আপনি যদি বাংলাদেশের খাদ্য ব্যবস্থা বুঝতে চান তাহলে আপনাকে পাঁচফোঁড়ন ব্যাপারটা খাদ্য ও রান্না ব্যবস্থার সামগ্রিক ক্ষেত্র থেকে বুঝতে হবে। অধিকাংশ রান্নার বইতে একে ‘মশলা’ বলা হয়। যদি পাঁচফোঁড়নকে তার বৈশিষ্ট্যসহ বুঝতে না পারেন তাহলে বুঝতে হবে বাংলাদেশের জনগণের খাবার ব্যবস্থা সম্বন্ধে আপনার বিশেষ ধারণা নাই। ‘মাছেভাতে বাঙালি’ কথাটা আমরা হামেশা বলি, তার সঙ্গে ডাল – কথাটা ঠিক না। সম্ভবত ঔপনিবেশিক ইংরেজ আমলে অভাবের চোটে এই ধরণের ক্ষুধার্ত কথাবার্তা তৈয়ার হয়েছে।
বাঙালি প্রধানত সবুজভুক প্রাণী, শাকশব্জি লতাপাতা কচুঘেঁচু শালুক ঢেপা ইত্যাদি তার খাদ্য ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ দিক। মাছের সঙ্গে তার বসবাস, ফলে তার খাদ্যে মাছ ঢুকেছে সন্দেহ নাই। কিন্তু মাংস তার খাদ্য ব্যবস্থার বাইরে থেকে আমদানি। আমরা একেকজন মোগলবাদশা হয়ে পেট ফুলিয়ে থাকবার গোমরে ভাবি শব্জি বুঝি খাদ্য ব্যবস্থার বিচারে নিম্ন পর্যায়ের। মোটেও না, শাকশব্জি লতাপাতার স্থান অনেক অনেক ওপরে। আমরা মুঘল আমল থেকে রাজা বাদশাহদের অনুকরণ করতে গিয়ে শব্জি খেতে ভুলে গিয়েছে। তাই শব্জিও পাক করি গোশতের মশলা দিয়ে। কিন্তু শব্জিতে গোশতের মশলা চলে না। এমনকি পেঁয়াজ, রসুন কিম্বা আদাও সবসময় নয়। যদি এইটুকু বোঝেন তো বাঙালির খাদ্য ব্যবস্থায় পাঁচফোঁড়নের গুরুত্ব বুঝতে আপনার অসুবুধা হবে না।
পাঁচটি বীজের মধ্যে রয়েছে জিরা (Cumin) মৌরি (fennel, মেথি (fenugreek). কালো জিরা (black cumin), ও কালো সরিষা (black mustard)। তবে বাংলাদেশে সরিষার বদলে রাঁধুনি (Wild celery) ব্যবহার করা হয়। ইংরেজিতে রাঁধুনি Wild celery নামে পরিচিত। বাংলাদেশে সরিষার জায়গা নেবার কারন এর গন্ধ ও স্বাদের বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া রাঁধুনি একান্তই বাংলাদেশের উদ্ভিদ। এখানে একটা বঙ্গীয় ব্যাতিক্রমও ঘটে গিয়েছে, সেটা হোল রাঁধুনি কিন্তু বীজ নয় গাছের ফল। অনেকে আবার সরিষার পরিবর্তে ধনে বা ধনিয়ার বীজ (coriander) ব্যবহার করেন। বাংলাদেশে ধনিয়া ও রাঁধুনি উভয়েরই চল আছে। কোথাও আবার পাঁচটি বীজের যে কোন একটি বা দুটি পরিবর্তে অন্য একটি বা দুটি বীজ যুক্ত হতে পারে। যেমন, রাঁধুনির পরিবর্তে সেলারি। অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট পাঁচটি বীজই ব্যবহার করতে হবে এমন না, সেখানে অদলবদল ব্যাতিক্রমের সুযোগ আছে।
পাঁচ বীজের পরিমান পাঁচফোঁড়নে কেমন হতে পারে নীচের টেবিল দিয়ে একটা ধারণা দিচ্ছি। আপনার ঘ্রাণ ও স্বাদের ইন্দ্রিয়তার তারতম্য অনুযায়ী একটু অদল বদল কমবেশী হতেই পারে: জিরা (দুই চামচ), মৌরি ( ১ চা চামচ), কালো জিরা (আধা চা চামচ), রাঁধুনি (২ চা চামচ) ar মেথি (১ চা চামচ)।
Reviews
There are no reviews yet.